🌍চ্যুতি ও চ্যুতি দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ🌍

🌍 নানা ধরনের চ্যুতি ও গঠিত ভূমিরূপ 🌍

------------------------------------------------------------

⛰️ সাধারণত ভূপৃষ্ঠে সম্প্রসারণ ও দুটি শিলাস্তরের মধ্যভাগের ফাটল বরাবর শিলাস্তরের উঠা নামা হয়ে থাকে। এমন ভূপৃষ্ঠের উপর পাশাপাশি অবস্থিত ফাটলগুলোকে বলা হয়ে থাকে চ্যুতি ( Fault ) । সাধারণত এই ফাটল বরাবর শিলাস্তরের উঠা নামা হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে বহিঃর্জাত শক্তির প্রভাবে ক্ষয় পেতে থাকে। 

⭐ চ্যুতিরেখা : যে রেখা বরাবর শিলাস্তরে চ্যুতি বা ফাটল দেখা যায় সেই কাল্পনিক রেখাকে বলা হয় চ্যুতিরেখা ।

⭐ ঝুলন্ত ও পাদপ্রাচীর : চ্যুতিরেখা বরাবর শিলাস্তরের যে অংশটি অন্য শিলার সপক্ষে ঝুলে থাকে তাকে ঝুলন্ত প্রাচীর এবং যে শিলার সপক্ষে প্রাচীর ঝুলে থাকে তাকে পাদপ্রাচীর বলে। 

⭐ আয়াম ও নতি ( Strike & Dip ) : সাধারণত দুটি আলাদা শিলাস্তরের মধ্যে যে ১৮০° কোন গঠিত হয় তাকে আয়াম ও একটি শিলাস্তর অন্য শিলাস্তরের উপর হেলে থাকার মানকে নতি বলা হয়। 

⭐ ভৃগুতট ( Scrap ) : চ্যুতির দুদিকে শিলাস্তর ওঠানামার সপক্ষে দুটো শিলাস্তরের মধ্যে যে দেওয়াল বা ঢাল তৈরি হয় তাকে ভৃগুতট বলে। 

⭐ Bedding Plane : একাধিক স্তরে শিলা গঠিত হলে যে তল বরাবর দুটো শিলাস্তরের মধ্যে বিভাজন টানা হয় তাকে Bedding Plane বলে। 

⭐ ক্ষেপ ও ব্যবধি : চ্যুতির ফলে দুটি শিলাস্তরের মধ্যে যে উলম্ব ব্যবধান তৈরি হয় তাকে ক্ষেপ ও অনুভূমিক ব্যবধানকে ব্যবধি বলে। 

⭐ চ্যুতিতল : যে তল বরাবর দুটো শিলাস্তরের মধ্যে উঠানামা হয়ে থাকে তাকে চ্যুতিতল বলে। 

🛑 চ্যুতির শ্রেণীবিভাগ : 

⭐ অনুলোম চ্যুতি : সাধারণত সম্প্রসারণ বা শিলাস্তরের টানের মাধ্যমেই অনুলোম চ্যুতি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ফাটলের বামদিকের শিলাস্তরের উত্থান হয়। পাদপ্রাচীর উপরদিকে উঠে থাকে এবং পাদপ্রাচীর সংলগ্ন ঝুলন্তপ্রাচীর কিছুটা নীচের দিকে অবস্থান করে। অনুলোম চ্যুতিকে স্বাভাবিক চ্যুতি বলা হয়ে থাকে। শিলাস্তরে টান থাকায় প্রতিসরণ লক্ষ্য করা যায়। অনুলোম চ্যুতিতে চ্যুতিতল ডানদিকে ঢালু হয়। শিলাস্তরের প্রতিগামী সরণ ঘটে। 

                      অনুুুুলোম চ্যুতি

⭐ বিলোম চ্যুতি : বিলোম চ্যুতি মূলত সংনমন বলের প্রভাবে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শিলাস্তর ডানদিকে উঠে থাকে। এক্ষেত্রে ঝুলন্ত প্রাচীর পাদপ্রাচীরের উপর অবস্থান করে। বিলোম চ্যুতিতে চ্যুতিরেখার দুপাশের শিলা পরস্পরের দিকে আসে। চ্যুতিতল বামদিকে হেলে থাকে। এই চ্যুতিকে বিপরীত চ্যুতি বা বিপরা চ্যুতিও বলা হয়। 

                         বিলোম চ্যুতি

⭐ আয়াম স্খলন চ্যুতি ( Strike slip fault ) :

সাধারণত দুটি শিলাস্তরের মধ্যভাগ দিয়ে যদি লম্বালম্বি রেখা টানা হয় তাকে আয়াম বলে। দুটি শিলাস্তরের মাঝের কাল্পনিক মধ্যতল হল আয়াম (Strike ) . আয়াম স্খলন চ্যুতিতে শিলাস্তরের আয়াম বরাবর প্রতিগামীতা বা বিপরীত মুখী চলন দেখা যায়। এর মান হয় ১৮০° ।

                 আয়াম স্খলন চ্যুতি

 নতি স্খলন চ্যুতি : সাধারণত একটি শিলাস্তর অন্য শিলাস্তরের উপর যে কোনে হেলে থাকে তাকে নতি ( Dip ) বলা হয়। অর্থাৎ ভূমিতল ও শিলাস্তরের মধ্যে যে কোন তৈরি হয় তাকেই নতি বলে। নতি স্খলন চ্যুতি আয়াম স্খলন চ্যুতির বিপরীত। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শিলাস্তরের চ্যুতিতল লম্বালম্বি না হয়ে শিলাস্তরের পর্যায়ক্রমিক ঢালের সমান্তরালে হয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী সরণ হয় । 

                     নতি স্খলন চ্যুতি

⭐ সোপান চ্যুতি : পরপর একাধিক অনুলোম চ্যুতি তৈরি হলে সিঁড়ির ধাপের ন্যায় দেখতে হয়। একে সোপান চ্যুতি বলা হয়। একদম নীচের শিলাস্তরের সপক্ষে দ্বিতীয় শিলাস্তরের উত্থান । দ্বিতীয়ের সপক্ষে তৃতীয় এইভাবে চলতে থাকে পর্যায়ক্রমে। আমি মনে করি একাধিক বেডিং প্লেন ধরে শিলাস্তরের পর্যায়ক্রমিক ভাবে একদিকে উঠার ফলেই সোপান চ্যুতি গড়ে ওঠে। সোপান কথার অর্থ সিঁড়ি। 

                       সোপান চ্যুতি

⭐ পরিখা চ্যুতি : দুই দিক থেকে সোপান চ্যুতি এসে একটি শিলাস্তরে মিলিত হলে এই চ্যুতি গড়ে ওঠে। মধ্যভাগের সংকীর্ণ অঞ্চলকে পরিখার মতো লাগে। 

                          পরিখা চ্যুতি

⭐ আনেশেলো চ্যুতি : অ্যানেশেলো চ্যুতি অনেকটা সোপান চ্যুতির ন্যায় হলেও নীচের অংশ মিশে যায়। ⭐ অরীয় চ্যুতি : এই চ্যুতির ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলে চ্যুতি গুলি মিলিত হয় । অরীয় কথার অর্থ হল কেন্দ্রাভিমুখী। 

⭐ থ্রাস্ট চ্যুতি : এক্ষেত্রে প্রবল একমুখী চাপের ফলে ভাঁজের মধ্যবাহু বরাবর ভাঙন তৈরি হয় । একসময় এই ফাটল বরাবর প্রবল চাপে সামনের শিলাস্তরের  উত্থান ও পিছনের শিলাস্তর নীচের দিকে ঢুকে যায়। 

⭐ কব্জা চ্যুতি : এই চ্যুতির ক্ষেত্রে শিলাস্তর কব্জার ন্যায় অবস্থান করে ও ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।

🛑 চ্যুতির ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ : 

⭐ স্তুপ পর্বত ও গ্রস্থ উপত্যকা : সাধারণত চ্যুতিরেখা বরাবর শিলাস্তরের উত্থান হয় ও অবনমন ঘটে। শিলাস্তরের উঠা অংশকে স্তুপ পর্বত বলে এবং নীচে নেমে যাওয়া অংশকে গ্রস্থ উপত্যকা বলা হয়। সাধারণত সম্প্রসারণ টানের ফলে দুটি চ্যুতির মাঝের অংশ বসে গিয়ে গ্রস্থ উপত্যকা তৈরি করে থাকে। আবার সংনমন শক্তির প্রভাবে কখনো কখনো দুটি চ্যুতিরেখার মাঝের অংশ বসে যায়। স্তুপ পর্বত গুলি জলবিভাজিকা হিসেবে কাজ করে থাকে। গ্রস্থ উপত্যকা দিয়ে নদী প্রবাহিত হয় । চ্যুতিরেখা বরাবর নদীর জলপ্রবাহ দেখা যায়। 

               স্তূপ পর্বত ও গ্রস্থ উপত্যকা

⭐ চ্যুতি ভৃগুতট : সাধারণত চ্যুতিতল বরাবর যে খাড়া ঢাল গড়ে ওঠে তাকে বলা হয় চ্যুতি ভৃগুতট । এই অঞ্চলে ঢালের মাত্রা বেশি থাকায় ক্ষয় বেশি হয়ে থাকে। এগুলি ধাপের মতো দেখতে হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ভৃগুতট ক্ষয় পেতে পেতে ঢালের পরিবর্তন হতে থাকে। সাধারণত চ্যুতি ভৃগুতটের ঢাল অনুলোম চ্যুতির ক্ষেত্রে ডানদিকে ও বিলোম চ্যুতির ক্ষেত্রে বা দিকে হয়ে থাকে। ক্ষয় পেতে পেতে শিলাস্তর ভূ পৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে এলে চ্যুতি রেখা বরাবর ভৃগুতট সৃষ্টি হয়ে থাকে। 

                          চ্যুতি ভৃগু

⭐ চ্যুতিরেখা ভৃগুতট : সাধারণত চ্যুতি ভৃগুতটের পরবর্তী অবস্থায় চ্যুতিরেখা বরাবর ভৃগুতট গড়ে ওঠে। সাধারণত এর ঢাল  তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। চ্যুতিরেখা ভৃগুতট দুধরনের হয়ে থাকে যথা Absequent আর Resequent. সাধারণত চ্যুতিরেখার দুপাশের শিলাস্তর প্রায় সমান হয়ে এলেও পূর্বের ভৃগুতটের ঢাল বরাবর অবরোহনের ফলে পাশের শিলাস্তরের কিছুটা উচ্চতা বাড়ে । এর ফলে বিপরীত দিক থেকে চ্যুতিরেখা বরাবর ভৃগুতট তৈরি হয় একে Absequent fault line scrap বলে। অন্যদিকে ভৃগুতটের ঢালের দিকেই আবার নতুন করে চ্যুতিরেখা বরাবর ভৃগুতট তৈরি হলে Resequent fault line scrap বলে। 

⭐ তির্যকচ্যুত স্তুপ পর্বত : সাধারণত স্তুপ পর্বতের দুদিক সমান ঢালে নামে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদিকে চাপ বেশি হলে ঢাল একদিকে হয়ে থাকে বা বেঁকে থাকে। সাধারণত তির্যক চ্যুতি বা নতি বরাবর চ্যুতি থেকে সৃষ্ট স্তুপ পর্বত এক মুখী ঢালমাত্রা লক্ষ্য করা যায়। 

🌍 চ্যুতি সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক : 

⭐ মহীভাবক ও গিরিজনি আলোড়ন ( সংনমন ও সম্প্রসারণ)। ⭐ বলের তীব্রতা ⭐ শিলাস্তরের প্রকৃতি ⭐ সময় ⭐ পাতসীমান্ত ⭐ পরিচলন স্রোত । সাধারণত ভূপৃষ্ঠের কোমল শিলা ক্ষয় পেয়ে আচর কাটা দাগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। পরে বহিঃর্জাত শক্তির প্রভাবে আরও গভীর হতে থাকে। যথেষ্ট গভীর হলে পরবর্তী পর্যায়ে ফাটল বরাবর শিলাস্তরের উত্থান ও পতন ঘটে এবং চ্যুতির সৃষ্টি হয়।  ভূ পৃষ্ঠের পরিচলন স্রোতের প্রভাবে নিরপেক্ষ পাতসীমান্ত বরাবর আয়াম স্খলন চ্যুতি হয়ে থাকে। যেমন স্যান আদ্রিজ চ্যুতি। অভিসারী পাতসীমান্ত বরাবর পাতের উর্দ্ধ ও অধগমন দেখা যায় এটিও এক ধরনের ফাটল।

সংনমন শক্তির প্রভাবে পাললিক শিলাস্তরে থ্রাস্ট চ্যুতি দেখা যায়। এছাড়া মহীভাবক আলোড়নের প্রভাবে উলম্ব উত্থানের ফলেও চ্যুতির সৃষ্টি হয়ে থাকে।

⭐ লেখা:অর্ঘ্য বটব্যাল

⭐ মডেল ও পর্যালোচনা: অর্ঘ্য বটব্যাল