🌏 জলবায়ুগত বৃহৎ নিয়ন্ত্রক সমূহ 🌏

🌏 জলবায়ুগত বৃহৎ নিয়ন্ত্রক সমূহ 🌏

-------------------------------------------------------

           জলবায়ুগত বৃহৎ নিয়ন্ত্রক সমূহ

সাধারণত আমরা জানি সমুদ্র জলতল তাপমাত্রা বায়ুর চাপ ও সম্পর্কিত বায়ুপ্রবাহকে পরিবর্তন করে থাকে। ব্যাপক ভাবে সাগরের দুটি বিপরীত মেরুতে তাপমাত্রার পরিবর্তন কোনো একটি বা একাধিক জলবায়ুর উপর প্রভাব বিস্তার করে। 

⭐ যেসমস্ত বিষয়গুলি সাগরের তাপমাত্রা, বায়ুরচাপ , বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের তারতম্যের সঙ্গে দায়ী সেগুলি হল - ১) দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাস ২) বায়ুর চাপের বৃহৎ অঞ্চলে পরিবর্তন ৩)  বায়ু প্রবাহের পরিবর্তন সক্রিয়তা ও দুর্বলতা ৪) স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন ৫) ঘূর্ণিঝড় ও ক্রান্তীয় সিস্টেমের উপর প্রভাব ৬) খরা ও বন্যা । 

🛑 এল নিনো : " প্রশান্ত মহাসাগরের দুষ্টু ছেলে হল  এল নিনো " । দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় এলাকায় হিম শীতল হামবোল্ট স্রোতের জায়গায়  জলতল তাপমাত্রা বেশি হয়ে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। সাধারণত নিরক্ষরেখার উভয় দিকে ২০° উ ও দ অক্ষাংশের মধ্যেই এল নিনো স্রোতের সব থেকে বেশি প্রভাব দেখা যায়। এল নিনোর দুষ্টুমিতে আটাকমা মরুভূমি পায় ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি। দ আমেরিকার পেরু উপকূলীয় এলাকায় নিম্নচাপ বলয় তৈরি হয় অন্যদিকে অষ্ট্রেলিয়া উপকূলীয় এলাকায় ও প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে তৈরি হয় উচ্চ্চাপ বলয়। এর প্রভাবে একধরনের নিম্নস্তরের বায়ু স্রোত ছুটে আসে দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে। বঙ্গোপসাগর , তৎসংলগ্ন এলাকায়  প্রশান্ত মহাসাগরে পূবালী বাতাসের গতি কমে যায়। অন্যদিকে দ আমেরিকার উপকূলে তীব্র পরিচলন পক্রিয়ায় ব্যাপক বৃষ্টি হয়ে থাকে। ভারতের বঙ্গোপোসাগর ও আরবসাগরে ঝঞ্ঝার পরিমান ও পোটেনশিয়াল শক্তি কমে যায়। 

🛑 লা নিনা : এল নিনোর বিপরীত অবস্থা হল লা নিনা। এটি একধরনের এল নিনোর মতোই পরিচলন পক্রিয়া। তবে অভিমুখ এল নিনোর বিপরীত। এক্ষেত্রে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হয় স্বাভাবিকের থেকে বেশি জলতল তাপমাত্রা। এবং পেরু ও চিলি উপকূলে বয়ে চলে শীতল হামবোল্ট স্রোত ( কুমেরু স্রোতের পরিবর্তিত অংশ) । দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম সমুদ্র জল তাপমাত্রা থাকে। ফলে পূর্ব প্রশান্ত থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নস্তরের বাতাসের অভিক্ষেপ ঘটে। এবং অষ্ট্রেলিয়া, মালয় , ফিলিপিন্স, ভারত সহ এশিয়ার বেশ কিছু জায়গায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী বৃষ্টি হয়ে থাকে। দেশ জুড়ে উদ্বৃত্ত বৃষ্টি হয়ে থাকে। লা নিনা শব্দের অর্থ শান্ত মেয়ে। 

🛑 এল নিনো ও লা নিনার তফাৎ : 

🌍 এলনিনোর প্রবাহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে থেকে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে হয়ে থাকে। লা নিনার ক্ষেত্রে প্রবাহ পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রশান্তের দিকে হয়।

🌍 এল নিনোর ক্ষেত্রে দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝার দাপট বাড়ে। এছাড়া উ আমেরিকার প উপকূলে প্রভাব বেশি পড়ে। লা নিনার ক্ষেত্রে প প্রশান্ত মহাসাগরে ও উ ভারত মহাসাগরে ক্রান্তীয় ঘূর্ণাবর্তের দাপট ও সংখ্যা বাড়ে। 

🌍 এল নিনো সময়ে ভারত , অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স , মাদাগাস্কার , ইন্দোনেশিয়াতে কম বৃষ্টি ও অস্বাভাবিক কম মৌসুমী বৃষ্টি দেখা যায়। লা নিনার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বা অতিরিক্ত ঝড়বৃষ্টির ফলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় বেশ কিছু জায়গায়। 

🌍 এলনিনোর সময়ে SST এর মান পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু, ইকুয়েডর ও চিলি উপকূলে বেশি হয়। লা নিনার ক্ষেত্রে প প্রশান্ত মহাসাগরের অষ্ট্রেলিয়ার পূর্ব দিকে ও প প্রশান্ত মহাসাগরে জলতল তাপমাত্রা বেশি হয়। অনেক গভীর পর্যন্ত জল উষ্ণ থাকে। 

🌍 এল নিনোয় পেরু ও চিলি উপকূলে পরিচলন পক্রিয়া বেশি হয়। লা নিনার ক্ষেত্রে প প্রশান্ত মহাসাগরে পরিচলন শক্তিশালী আরো হয়ে ওঠে। 

🌍 এল নিনোয় ভারত , বাংলাদেশ, অষ্ট্রেলিয়ায় মৌসুমী বায়ু দুর্বল হয় অন্যান্য বছরের তুলনায়। লা নিনায় উপযুক্ত পরিবেশে সক্রিয় ও অতিসক্রিয় হয়। 

🌍 এল নিনোয় হামবোল্ট স্রোত দুর্বল হয়ে উষ্ণ এলনিনো স্রোত প্রবাহিত হয়। লা নিনার সময় স্বাভাবিক হামবোল্ট স্রোত বয়ে যায়। 

🌍 এলনিনোয় পেরু উপকূলে নিম্নচাপ হয়। লা নিনার ক্ষেত্রে অষ্ট্রেলিয়া সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়। 

🛑 ওয়াকার সার্কুলেশন : সাধারণত  লা নিনা একটি বৃহত্তর পরিচলন পক্রিয়া। শুধু মাত্র বায়ুর পরিচলন নয় সমুদ্র জলের উষ্ণতা ও শীতলতার তারতম্যে অভ্যন্তরীণ পরিচলন হয়ে থাকে। সাধারণত উচ্চ্চাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে নিম্নস্তরের বায়ুস্রোত গেলেও নিম্নচাপ কেন্দ্রে বায়ুর উর্দ্ধ গমন ও পরে ঘনীভবন , লীন তাপ ছাড়ার মধ্যে দিয়ে শীতল বাতাস উর্দ্ধ স্তর থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে উচ্চ্চাপে নেমে আসে। এটা একটা চক্রের মতো ক্রিয়াশীল হয়। যেমন : বায়ুর নিম্নচাপের দিকে যাওয়া - বায়ুর চাপ হ্রাসে ওপরে ওঠা - ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া - উচ্চ্চাপের দিকে সরে এসে নিম্ন মুখী হয়া। এই ধরণের চক্র এল  লা নিনার ক্ষেত্রে দেখা যায়। এটাই ওয়াকার সার্কুলেশন। 

🛑 IOD ( Indian Ocean Dipole ) : ভারত মহাসাগরে প্রায় ১৮০° বিপরীত দিকে জল তাপমাত্রা তারতম্যের জন্য সমুদ্র জলের আপলিফ্ট হয়। এর পাশাপাশি বায়ু স্রোত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ভারত মহাসাগর থেকে পশ্চিম ও সংলগ্ন উত্তর পশ্চিম ভারত মহাসাগর ও আরবসাগরের দিকে অগ্রসর হয়। ফলে ওই সমস্ত অঞ্চলে ব্যাপক পরিচলন পক্রিয়া দেখা যায়। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল , আরবসাগর, ভারতের পশ্চিম উপকূলে ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি ও ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝা দেখা যায় অন্যান্য বছরের তুলনায়। পক্ষান্তরে বঙ্গোপোসাগর, মালয় , অষ্ট্রেলিয়ার প উপকূলে ঝড়বৃষ্টির মাত্রা কমে। এই ঘটনা হল ভারত মহাসাগরীয় দ্বিমেরু। সাধারণত নিরক্ষরেখার উভয় দিকে ১০-২০° উ  ও দ পর্যন্ত এর প্রভাব দেখা যায়। 

⭐ যেহেতু iod এর আচরণ এল নিনোর মতো তাই Iod কে ইন্ডিয়ান নিনো বলা হয়। 

⭐ IOD তিন ধরনের হয় - পজেটিভ, নেগেটিভ ও নিউট্রাল IOD .

⭐ পজেটিভ ডাইপোলে আরবসাগর , নেগেটিভ ডাইপোলে বঙ্গোপোসাগর, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, মায়ানমার, প অষ্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টির মান ও ঝঞ্ঝা বেশি হয়। 

🛑 সাউদার্ন ওসিলেশন : প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে চাপ ও উষ্ণতার পার্থক্যের কারণে বৃষ্টির তারতম্য হয়ে থাকে। দক্ষিণ গোলার্ধে এই দোলন ও পরিচলন দেখা যায় তাই সাউদার্ন অসিলেশন বলা হয়। এটি হলো এল নিনোর  অবস্থার পরিচলন পক্রিয়া। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উষ্ণ জলস্রোত ও বাতাস দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এসে উর্দ্ধমুখী ও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি ঘটিয়ে শুষ্ক ও শীতল অবস্থায় ক্রমশ প প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। সাউদার্ন ওসিলেশন এলনিনো অবস্থার পরিচলন চক্র।

🛑 ওয়াকার সার্কুলেশন ও সার্দান ওসিলেশনের তফাৎ : 

🌏 সার্দান ওসিলেশন এল নিনো অবস্থার পরিচলন চক্র। ওয়াকার সার্কুলেশন লা নিনা অবস্থার পরিচলন চক্র।

🌏 ওয়াকার সার্কুলেশনে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে বায়ুপ্রবাহ ঘটে। এবং উত্থান হয়ে পুনরায় ফিরে আসে শীতল বাতাস হিসাবে দ আমেরিকার উপকূলীয় এলাকায়। সার্দান অসিলেশনের ক্ষেত্রে উষ্ণ স্রোত ও বাতাসের প্রবাহ হয় নিম্নস্তরে দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে। সেখান থেকে উপরে উঠে ঘনীভবন ও লীনতাপ ছাড়ার পর উপরের স্তরের শীতল বাতাস ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় এলাকায় বা প প্রশান্ত মহাসাগরে। 

🌏 ওয়াকার সার্কুলেশনে প প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। সার্দান অসিলেশনের ক্ষেত্রে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। 

🌏 এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ঝড়বৃষ্টি হয় বেশি। দ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ঝড়বৃষ্টি বেশি হয়। 

🛑 এলনিনো, লা নিনা , IOD এর প্রভাব : 

⭐ এলনিনোর ফলে পূর্ব এশিয়া ও উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মৌসুমী বায়ু অন্যান্য বছরের তুলনায় দুর্বল হয় । ক্রান্তীয় ঘূর্ণাবর্তের মাত্রা কমে যায়। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমে যায়। এবং তৈরি হলেও দুর্বল হয়ে যায় বা পূর্ব প্রশান্তের দিকে অগ্রসর হয়। এর ফলে বঙ্গোপোসাগরে টাইফুনের পালস প্রবেশ অনেক কমে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় ঝড়বৃষ্টি কম থাকে। পূবালী বাতাসের গতি কমে যায়। আবার উর্দ্ধ স্তরে পূবালী বাতাস বেড়ে যাওয়ায় ঝড়বৃষ্টির তারতম্য হয়। 

⭐ পূ প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ায় ওই সমস্ত অঞ্চলে ঝড়বৃষ্টি বেশি হয়। আটাকামা মরুভূমিতে বৃষ্টি হয়। ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝার পরিমান বাড়ে।

⭐ লা নিনার সময় প প্রশান্ত মহাসাগরে পরপর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। যার পরিত্যক্ত অংশ (Pulse ) বর্ষার সময় মায়ানমার , ভিয়েতনাম হয়ে বঙ্গোপোসাগরে পড়ে শক্তিশালী হয়ে গভীর নিম্নচাপ বা নিম্নচাপে পরিণত হয়। ফলে ভারত সহ পূর্ব এশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়াতে ঘূর্ণিঝড় , নিম্নচাপের বৃষ্টি বাড়ে। ভারতের উপর মৌসুমী অক্ষরেখা সক্রিয় হয় যার জন্য মৌসুমী বৃষ্টি বেশি হয়। চাষবাস ভালো হয়। পূবালী বাতাস সক্রিয় থাকায় বৃষ্টি হয়। 

⭐ ডাইপোল ধনাত্মক হলে আরবসাগর, আফ্রিকায় ঝড়বৃষ্টির পরিমান বাড়ে। ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝা

বঙ্গোপসাগরের তুলনায় আরবসাগরে বেশি হয়। পশ্চিম ভারতে বেশি বৃষ্টি হলেও পূর্ব ভারত বঞ্চিত হয় কিছুটা। মৌসুমী বায়ুর আরবসাগরীয় শাখা সক্রিয় হয়। নিরপেক্ষ ডাইপোলে সমগ্র ভারত, আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টি স্বাভাবিক হয়। ঋনাত্মক ডাইপোলে বঙ্গোপোসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা বাড়ে। ভারতের পূর্ব, বাংলাদেশ , মায়ানমার ও অষ্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হয়। 

🛑 লেখা :অর্ঘ্য বটব্যাল

🛑 পর্যালোচনা: অর্ঘ্য বটব্যাল